চাকরির ইন্টারভিউতে সাধারণ কিছু ভুল

যে কোন পেশায় আবেদন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে ইন্টারভিউ হল 'হয় ভাঙো নয়ত মচকাও' অংশ। আপনার জীবন-বৃত্তান্ত বা সিভি আপনাকে ইন্টারভিউ অবধি নিয়ে যেতে পারে, আর ইন্টারভিউ আপনাকে চাকরি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। আপনার সম্ভাব্য নিয়োগকর্তাকে আপনার‌ এমনভাবে খুশি করতে হবে যেন এই পদে আপনার চাইতে বেশি অন্য কাউকে উপযুক্ত বলে মনে না নয়।

আপনি যত স্মার্ট আর সুযোগ্য প্রার্থীই হোন না কেন, চাকরির ইন্টারভিউতে যেতে হলে আপনাকে প্রস্তুতি নিতেই হবে। ইন্টারভিউ একটা যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। এখানে প্রথমেই নিজের সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা দিতে হবে। ভুল করলে দ্বিতীয় সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। তাই ইন্টারভিউ দক্ষতা বাড়াতে কিছু কৌশল গ্রহণ করুন।

১. পোশাক হওয়া চাই মার্জিত:
ক্যাজুয়াল ড্রেসে ইন্টারভিউতে যাওয়া ঠিক নয়। আপনাকে মার্জিত পোশাক পরতে হবে। আপনার মাঝে পেশাদার ও দক্ষতার ছাপ থাকা জরুরি। যে কোম্পানিতে, যে পদের জন্য আবেদন করেছেন আপনি, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মার্জিত পোশাক পরা উচিত। সম্ভব হলে ইন্টারভিউয়ের আগে কোম্পানির ড্রেস কোড সম্পর্কে জেনে নেবেন।

২. আপনার জোরালো উপস্থিতি বোঝাতে হবে:
কথা না বলেই ইন্টারভিউ রুমে ঢুকে প্রথমেই আপনার জোরালো উপস্থিতি বোঝাতে হবে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ইন্টারভিউয়ারদের সালাম দিন। তাদের  চোখে চোখ রাখুন, এরপর ভদ্রভাবে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে হ্যান্ডশেক করুন। এভাবে কোনো কথা ছাড়া আচরণের মাধ্যমেই আপনার ইন্টারভিউয়ের দারুণ সূচনা হতে পারে। নয়তো দ্রুত শেষ হয়ে যেতে পারে ইন্টারভিউ।

৩. শুনুন:
ইন্টারভিউয়ের শুরু থেকেই প্রশ্নকর্তা আপনাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বেশ কিছু তথ্য দিতে পারেন। যদি সেগুলো আপনি না শোনেন, তাহলে বড় কোনো সুযোগ হারাতে পারেন। ভালো যোগাযোগের ক্ষেত্রে শোনা এবং যিনি কথা বলছেন তার কথাগুলো যে আপনি শুনেছেন, সেটি তাকে বোঝানো জরুরি। প্রশ্নকর্তা কীভাবে, কোন স্টাইলে কথা বলছেন, তা উপলব্ধি করুন।

৪. বেশি কথা বলবেন না:
প্রশ্নকর্তা যা জানতে চান, তার চেয়ে বেশি কথা বলা আপনার জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। যদি পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকে, তাহলে প্রশ্নকর্তার নানা প্রশ্নে খেই হারিয়ে ফেলতে পারেন আপনি। এতে নার্ভাস হয়ে বকবকও করতে পারেন। তাই ইটারভিউর জন্য পর্যাপ্ত পড়াশোনা করে যাবেন। পাশাপাশি ইন্টারভিউর আগে বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরি করে কোনো বন্ধু বা আত্মীয়ের সহায়তা নিয়ে ইন্টারভিউ দেওয়ার চর্চা করবেন। আর যে পদের জন্য আপনি আবেদন করেছেন, তা সম্পর্কে, পদের জন্য যেসব অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে, সেসব বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে তারপর ইন্টারভিউতে যাবেন।

৫. বেশি গা ছাড়া ভাব দেখাবেন না:
চাকরির ইন্টারভিউতে আসলে পেশাদার একটি আমেজ থাকে। এখানে কেউ আপনার বন্ধু না বা নতুন বন্ধু হওয়ার সুযোগ নেই। তাই প্রশ্নকর্তা যে ভঙ্গিতে প্রশ্ন করছেন, তাকে অনুসরণ করে সেভাবেই উত্তর দিন। ইন্টারভিউয়ের সময় আপনার ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ, আত্মবিশ্বাস, আগ্রহ প্রকাশ করা এবং প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করাও জরুরি। তবে খেয়াল রাখতে হবে এসব যেন দৃষ্টিকটু না হয়।

৬. উপযুক্ত ভাষায় কথা বলুন:
ইন্টারভিউয়ের সময় আপনাকে পেশাগত ভাষায় কথা বলতে হবে। খেয়াল রাখবেন যেন আপনার কোনো অনুপযুক্ত শব্দ (হতে পারে তা ধর্ম, রাজনীতি বা অন্য যেকোনো বিষয়ে) চয়ন যেন প্রশ্নকর্তাদের বিব্রত না করে। তাহলে তাৎক্ষণিকভাবেই আপনার ইন্টারভিউ শেষ হয়ে যেতে পারে।

৭. শিষ্টাচার বজায় রাখুন:
ইন্টারভিউতে উতরে যাওয়ার ক্ষেত্রে আপনার আচরণ একটি বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। ইন্টারভিউ রুমে আত্মবিশ্বাস, পেশাদারিত্ব আর শিষ্টাচার এসবের মাঝে সুন্দর ভারসাম্য রক্ষা করতে পারলে জয় আপনার হবেই। উল্টোদিকে আপনি যোগ্যতর হলেও অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাস আর উদ্ধত আচরণ আপনার সুযোগ নষ্ট করে দিতে পারে।

৮. উত্তর দিন সতর্কতার সঙ্গে:
প্রশ্নকর্তা যখন আপনার ক্যারিয়ারের আগের কোনো ঘটনা জানতে চান, তখন আপনার আচরণের ধরন বোঝারও চেষ্টা করেন তিনি। এ ক্ষেত্রে যদি নির্দিষ্ট উদাহরণ দিয়ে উত্তর দিতে না পারেন, তাহলে একদিকে আপনি যেমন যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পাবেন না, অন্যদিকে নিজের দক্ষতা সম্পর্কেও কথা বলার সুযোগ হারাবেন। তাই আগে থেকেই প্রস্তুতি নেবেন যেন নিজের সব ঘটনা সুন্দরভাবে গুছিয়ে বলতে পারেন।

৯. প্রশ্ন করুন:
আপনার ইন্টারভিউ এর প্রশ্নগুলো সম্পর্কে যথাসম্ভব পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করা যতটা অত্যাবশ্যক, ঠিক ততটা অত্যাবশ্যক ইন্টারভিউতে আপনার নিয়োগকৃত পদের অবস্থান এবং কোম্পানী সম্পর্কে নিয়োগকর্তাকে করার জন্য প্রশ্ন প্রস্তুত করা। নিয়োগকর্তারা তাদের চাইতে এক ধাপ বেশি চিন্তা করে এমন প্রতিযোগীদের সম্পর্কে আগ্রহী। সুতরাং ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রশ্নকর্তাকে করার মতো কিছু প্রশ্ন তৈরী করে ফেলুন যেন ইন্টারভিউতে বসে এটা আপনাকে চিন্তা করে বের করতে না হয়। প্রশ্নকর্তা যখন জিজ্ঞেস করেন, 'আপনার কোনো প্রশ্ন আছে কি না?' তখন বেশির ভাগ প্রার্থী উত্তর দেন ‘না’। এটি আসলে ভুল। প্রশ্ন করার মাধ্যমে আপনি জানতে পারেন, কোম্পানিটি আপনার জন্য সঠিক জায়গা হবে কি না।

১০. অপ্রস্তুত উত্তর:
সাধারণত ইন্টারভিউ এর প্রশ্নগুলো সম্পর্কে সবার জানা আছে, সুতরাং সেগুলো সম্পর্কে প্রস্তুতি গ্রহন করুন। আপনার সমসাময়িক প্রশ্ন এবং উত্তরগুলো জানার চেষ্টা করুন, 'আপনার ক্ষমতা এবং দুর্বলতাগুলো কি কি?' 'আগামী দশ বছরে আপনি নিজেকে কোথায় দেখতে পছন্দ করবেন?' 'আপনি এই কোম্পানিতে এমন কি আনতে পারেন যা অন্য কেউ করতে পারেন না বা যা অন্য কেউ পারবে না?' 'আপনার ক্যারিয়ার এর কোন অংশটি আপনাকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে?' উল্লেখিত এই প্রশ্নগুলো সাধারণত বেশিরভাগ ইন্টারভিউতে করা হয়।

১১. মরিয়া হবেন না:
চাকরিটি আপনার খুব জরুরি হতে পারে। কিন্তু ইন্টারভিউয়ের সময় ‘প্লিজ আমাকে চাকরিটা দিন’ ধরনের মরিয়া ভাব দেখাবেন না। এতে আপনার আত্মবিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ইন্টারভিউয়ের সময় ধীর, স্থির ও দৃঢ়সংকল্প থাকুন। আপনি জানেন চাকরিটা পাওয়ার যোগ্যতা আছে আপনার। প্রশ্নকর্তাকেও সেটা বুঝতে দিন।

১২. ভুল করে কিছু বলা:
এই ভুলগুলো নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হলেও, মানুষ প্রায়ই এগুলো করে থাকে। মানুষ দুর্ঘটনাক্রমে ভুল জিনিস বা ভুল ধারণা করে থাকে, কোন কোন ক্ষেত্রে কাউকে ছোট দেখানো অথবা হেয় প্রতিপন্ন করার মতো ভুলগুলো করে থাকে। এই ধরনের যেকোন একটি ভুল আপনাকে নিক্ষেপ করতে পারে ইন্টারভিউ এর বাইরে। সুতরাং যথাসম্ভব বুদ্ধিমত্তার এবং বিবেচনার সাথে সাথে আপনি যা বলছেন তার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।

১৩. মুঠো ফোনের রিংটোন:
আপনার ফোনটি বন্ধ কিনা ইন্টারভিউ এর পূর্বে তা নিশ্চিত করুন। ইন্টারভিউ এর সময় মুঠো ফোনের রিংটোন শোনার মতো বিরক্তিকর আর কিছুই নয়।

১৪. সময় পরীক্ষা করা:
ইন্টারভিউ এর মাঝখানে আপনার ঘড়ি বা দেওয়ালঘড়ি এর প্রতি নজর না দেওয়ার প্রতি সতর্ক থাকুন। সাক্ষাৎকারের পূর্বে আপনার ঘড়িটি বন্ধ করে নিতে পারেন যেন ইন্টারভিউ এর সময় দুর্ঘটনাক্রমে আপনার চোখ ঐদিকে না যায়।

১৫. অন্যান্য কাজের প্রস্তাব সম্পর্কে বলা:
যদি আপনি ইচ্ছা পোষন করে থাকেন অন্যান্য কোম্পানি আপনাকে কি পজিশন প্রস্তাব করছে সে সম্পর্কে বলার, তবে সেটি হবে একটি হাস্যকর ইন্টারভিউ। এটাকে পৃথক রাখা গুরুত্বপূর্ণ। তারা ভাবতে পারেন আপনি ইতিমধ্যে একটি কাজ পেয়েছেন বা অন্য কোথাও কাজ করছেন। তারা হয়ত এমন কাঊকে কেন চাকরি দিবে না যে একটি কাজ পেয়েছে বা অন্য কোথাও কাজ করছে।

১৬. মিথ্যা:
যদিও চাকরির ইন্টারভিউতে এটি কমন যে আপনার জীবনবৃত্তান্ত বিস্তারিতভাবে ব্যাখা করবেন, তথাপি কোন মিথ্যা তথ্য প্রদান করা নিতান্তই ভুল। সততা একজন কর্মীর সবচেয়ে বড় গুণমান এবং একজন নিয়োগকর্তা ইন্টারভিউতে আপনার সত্য ও সততাকে সম্মান করবেন। আপনি কোথাও কাজ না করে থাকলে এই ধরনের কিছু আছে বলে দাবি করবেন না।

আশা করি এই সাধারণ টিপসগুলো চাকরির ইন্টারভিউ পর্বে আপনাকে সাহায্য করবে।

Rangpur Today
Related Posts
Previous
« Prev Post